ডেস্ক রিপোর্ট: ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় চাদেঁর হাসি স্বাস্থ্য সেবা প্রকল্পে গণ নিয়োগ শুরু হয়েছে। ধোবাউড়া উপজেলার সহজ সরল বেকার যুবক যুবতিদের ৫হাজার থেকে-১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জামানত নিয়ে চলছে এ গণ নিয়োগ প্রক্রিয়া। আসলেই চাকুরী নাকি সুপরিকল্পিত প্রতারণা এ নিয়ে চলছে ব্যাপক জল্পনা কল্পনা। আর এ জল্পনা কল্পনার মধ্যেই চোখে পড়ল এই খবরটি-
‘প্রসব-পূর্ব, গর্ভবতী ও প্রসব পরবর্তী সেবা, কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যসেবা, যৌন স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ …’ এরকম চটকদার নয় ধরণের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কথা উল্লেখ করে তৈরি করা হয়েছে সেবা গ্রহীতা কার্ড। কিন্তু বাস্তবতা হলো- কার্ডের ঘোষণা মোতাবেক নেই কোনো চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার সরঞ্জাম কিংবা ঔষধপত্র। বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার ফাঁদ পেতে ‘চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে এমএলএম পদ্ধতিতে চলছে অভিনব এ প্রতারণা। এছাড়া জামানতের নামে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সরফরাজ খান বাবুল বলেন, চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যসেবা চালানোর বৈধতা নেই। এমনকি জেলা সিভিল সার্জন থেকে সেবা কার্যক্রম চালানোর অনুমতিও নেয়নি তারা। সিভিল সার্জন বলেন, এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম এবং স্বাস্থ্যকর্মী পদে নিয়োগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের একটি দৈনিকসহ একাধিক পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবা নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্মারক নং-প্রশা ৪/বিবিধ-২/২০০৮/১৯৭৬ ইএলইএফসিএস কর্তৃক পরিচালিত গভ. রেজি নং এস-১১৬৬০, চট্টগ্রাম বিভাগে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা, এইচআইভি, পরিবার পরিকল্পনা, টিকাদান কর্মসূচিসহ ফ্রি প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে শর্ত সাপেক্ষে বিভাগ পরিচালক পদে ৪, জেলা পরিচালক পদে ৪৮, পরিচালক (উপজেলা) ১২০, ইউনিয়ন অফিসার ৩০০ ও ওয়ার্ড স্বাস্থ্যকর্মী ৬০০ জন লোক নিয়োগ দেয়া হবে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় অফিস হিসেবে চান্দগাঁও খাজা রোডে হাজি আবু তাহের ভবনের ঠিকানা রয়েছে।
বিভাগীয় অফিসে দেখা দেখা মিলে কয়েকজন নারী-পুরুষের। তারা কার্যালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানান। তবে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করার আগে কী উদ্দেশ্যে আসা হয়েছে তা জানতে ব্যস্ত ছিলেন। চাকুরির উদ্দেশ্যে আসা হয়েছে উল্লেখ করা হলে তারা বলেন, আমাদের পরিচালক ও নির্বাহী পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
মুঠোফোনে পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন রানার সাথে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিষয়ে কথা হয়। তিনি নিজেকে পরিচালক ও ঢাকাস্থ প্রধান অফিসে থাকেন বলে জানান এবং সংবাদ মোহনা নামে একটি পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক বলেও দাবি করেন। পটিয়া উপজেলার এক আত্মীয়কে নিয়োগ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সমগ্র দেশে আমাদের নিয়োগ চলছে। চট্টগ্রাম বিভাগেও নিয়োগ দিচ্ছি। তবে চট্টগ্রাম বিভাগের এখনো বিভাগ ও জেলা পরিচালক নিয়োগ দিইনি। ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলছে। খাজা রোডে বিভাগীয় অফিস উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে রত্মা নামের একজন দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়োগপ্রার্থী এইচএসসি পাস বলা হলে রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ভালোই। খারাপ না। দিয়ে দেন। পটিয়া অফিস বা ইউনিয়ন অফিসে কাজ করতে পারবে। না হলে নগরের যেকোনো থানায় কাজ করবে। উপজেলা-থানা বা ইউনিয়ন পরিচালক হিসেবে কাজ করতে পারবে। বেতন ঠিক থাকবে তো – এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই’ ঠিক থাকবে। দিয়ে দেন কাজ করুক। আবেদনে আপনার রেফারেন্স দিয়েন, আমি দেখব। অফিস, প্রশিক্ষণ, সেবা প্রদানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বসে আলাপ আলোচনা করেই তা ঠিক করব। তবে অফিস নিজে করলেই ভালো। তাদের কার্যক্রম কী হবে – জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সদস্য সংগ্রহ, মাঠকর্মীদের প্রশিক্ষণ, প্রাথমিক ঔষধ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা দেয়া। পরিচালক দাবিদার রিয়াজ আরও বলেন, একশ টাকার বিনিময়ে আমাদের সদস্য হলে একজন এমবিবিএস ডাক্তার, একজন প্রশিক্ষিত পল্লী ডাক্তার, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাসহ জ্বর-প্রেসার চিকিৎসা সেবার সুযোগ-সুবিধা পাবেন। সব খরচ আমরা বহন করব। আমরা জেলা, উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে শাখা দিব। সেখানে গিয়ে আমাদের সদস্যরা সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। নিয়োগপ্রাপ্তিতে সদস্য সংগ্রহ করতে হবে – এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো সূর্যের হাসি, ব্র্যাক বা অন্য সংস্থার সদস্যদের চিকিৎসা দেব না। আমাদের সদস্যদের আমরা স্বাস্থ্য সেবা দেব।
নিয়োগকালীন জামানতের বিষয়ে রিয়াজ উদ্দিন বলেন, কোনো জামায়াত দিতে হবে না। তবে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা দিয়ে প্রেসার ও জ্বর মাপার যন্ত্র, এপ্রোন ও অন্যান্য সামগ্রী কিনে নিতে হবে। এগুলো তো ফ্রি দিলে কদর থাকবে না। যদি তা বিক্রি করে গার্মেন্ট বা অন্য কোথাও চাকরি নেয়, তাহলে আপনি তাদের খুঁজবেন কোথায়। কিনে না নিলে যতœ থাকবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঠকর্মীদের কাছ থেকে জামানতের নামে প্রতিজন থেকে নেয়া হচ্ছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এছাড়াও শাখা পরিচালকদের কাছ থেকেও ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। ব্যানার সাঁটিয়ে এবং পত্রিকায় চটকদার ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে নগর এবং জেলাজুড়ে এলএমএল পদ্ধতির প্রতারণার নতুন ফাঁদ আঁটা হয়। ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খুলে ওইসব শাখায় পরিচালক এবং স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের নামে তাদের কাছ থেকে জামানত হিসেবে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
স্বাস্থ্যকর্মীদের শেখানো হয় সাধারণ সদস্য সংগ্রহের পদ্ধতি আর হেলথ কার্ড বিক্রয়ের কলাকৌশল। ফ্রি চিকিৎসা সেবার কথা বলে একশ’ টাকায় হেলথ কার্ড বিক্রয় করা হয়। ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে এমএলএম পদ্ধতিতে প্রতারণার নতুন কৌশল বলে মন্তব্য করেছেন অভিজ্ঞ মহল।
এ বিষয়ে কথা হয় পেকুয়ার হেলাল উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, পত্রিকায় ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ পেয়েই মোবাইল ফোনে চাঁদের হাসি স্বাস্থ্য সেবার নির্বাহী পরিচালকের সাথে যোগাযোগ হয়। পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন রানার পরামর্শে নগরীর বহদ্দারহাট খাজা রোডে বিভাগীয় অফিসে আসি। তিনি পরিচয় করিয়ে দেন পরিচালক মো. পারভেজ শেখ (হৃদয়), ট্রেইনার রেবেকা সুলতানা (রেখা) এবং মহানগর সমন্বয়কারী মো. হাসানসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে। পরে আমাকে ঢাকার যাত্রাবাড়ির দয়াগঞ্জ মোড়ের পারগেন্ডারিয়ায় নেয়া হয়। সেখানে চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবার চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়ে কথা বলেন বাতেন নামের একজন। আমাকে চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবার পেকুয়া জেলা শাখার দায়িত্ব দেয়া হয়। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে ওই শাখায় বেশ কিছু স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। জামানতের সংগৃহীত টাকা চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষের একটি ব্যাংক একাউন্টে এবং নগদে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৬৫ হাজার টাকা জমা দেন। কিন্তু চিকিৎসা সরঞ্জাম কিংবা প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার মত প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসক সরবরাহ না করায় আমার সন্দেহ সৃষ্টি হয়।
হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ করে আমি এখন নিঃস্ব। পেকুয়ায় থাকতে পারছি না। নিয়োগ দেয়া স্বাস্থ্যকর্মীরা টাকা ফেরত চাচ্ছেন। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলাম প্রতারক চক্রের জালে আটকে গেছি।
আর দোকানে দোকানে মশার কয়েল বিক্রয়কর্মী মো. হাসান চাঁদের হাসি স্বাস্থ্য সেবার মহানগর সমন্বয়কারী। স্থানীয় দোকানদার আবুল বশর ১৫ হাজার টাকা জামানতের বিনিময়ে চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবা’র আরেফিন নগর শাখায় নিয়োগপত্র পেয়েছেন শাখা পরিচালক পদে। চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন ডা. এমরানুল হোছাইন। তাকে চট্টগ্রাম মহানগর জেলা মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার পরিচিতি কার্ডে লেখা আছে, হায়ার ডিপ্লোমা ইন প্যারামেডিক্স (ঢাকা), এইচপিটিপি (ঢাকা)। জেনারেল ফিজিশিয়ান, স্বাস্থ্য পরিচালক, চট্টগ্রাম মহানগর/ জেলা।
নিয়োগপত্রে উল্লিখিত এমরানুল হোছাইনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জামানতের টাকা-পয়সা নিয়ে আমাদের একটি করে ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা না থাকায় আমি পদত্যাগ করেছি। জামানতের ছয় হাজার টাকা এখনো ফেরত দিচ্ছে না। আমাদের এলাকা থেকে এভাবে লাখ দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, আরেফিন নগর শাখা অফিসের ভিতরে সাঁটানো পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ফটোকপি। সামনে ঝুলছে বিভিন্ন পদবিধারী ব্যক্তিবর্গের নামের সাথে পরিচালক মো. পারভেজ শেখের ছবি এবং ‘চাঁদের হাসিতে স্বাস্থ্য সেবা নিন, অপরকে সেবা নিতে উৎসাহিত করুন’ লেখা সম্বলিত ডিজিটাল রঙিন ব্যানার। স্বাস্থ্যকর্মীরা একশ’ টাকায় হেলথ কার্ড বিক্রয় করছেন বলে জানান কয়েকজন মাঠকর্মী।
জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুযায়ী শাখা পরিচালক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা মাঠ পর্যায়ে সদস্যদের নিকট কথিত হেলথ কার্ড বিক্রয় করবেন। মাসে একজন স্বাস্থ্যকর্মী কমপক্ষে একশ টাকা মূল্যের তিনশ’ হেলথ কার্ড বিক্রয় করলে ওই স্বাস্থ্যকর্মী বেতন পাবেন ছয় হাজার টাকা আর পরিচালক পাবেন ১০ হাজার টাকা। যেসব স্বাস্থ্যকর্মী তিনশ’ হেলথ কার্ড বিক্রয় করতে পারবেন না তাদের চাকরি স্থায়ী হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাঠকর্মী জানান, ‘ছয় হাজার টাকা জামানত দিয়ে মাসিক আট হাজার টাকা বেতনে স্বাস্থ্যকর্মী পদে নিয়োগ দেয়া হয়। একশ টাকা মূল্যের তিনশ হেলথ কার্ড বিক্রয় করা হলে বেতন-ভাতা পাওয়া যাবে এবং চাকরি স্থায়ী হবে। আমি যে একটি প্রতারক চক্রের ফাঁদে আটকা পড়েছি তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। অভিযোগ করে তিনি বলেন, নতুন আঙ্গিকে এমএলএম পদ্ধতির লোভনীয় ফাঁদে ফেলে জামানতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে।
সূত্র: দৈনিক পূর্বকোণ-২৭-০২-২০১৫ খ্রি:
আরো খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন-
এখানেও ক্লিক করুন
‘প্রসব-পূর্ব, গর্ভবতী ও প্রসব পরবর্তী সেবা, কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যসেবা, যৌন স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ …’ এরকম চটকদার নয় ধরণের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কথা উল্লেখ করে তৈরি করা হয়েছে সেবা গ্রহীতা কার্ড। কিন্তু বাস্তবতা হলো- কার্ডের ঘোষণা মোতাবেক নেই কোনো চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার সরঞ্জাম কিংবা ঔষধপত্র। বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার ফাঁদ পেতে ‘চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে এমএলএম পদ্ধতিতে চলছে অভিনব এ প্রতারণা। এছাড়া জামানতের নামে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সরফরাজ খান বাবুল বলেন, চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যসেবা চালানোর বৈধতা নেই। এমনকি জেলা সিভিল সার্জন থেকে সেবা কার্যক্রম চালানোর অনুমতিও নেয়নি তারা। সিভিল সার্জন বলেন, এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম এবং স্বাস্থ্যকর্মী পদে নিয়োগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের একটি দৈনিকসহ একাধিক পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবা নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্মারক নং-প্রশা ৪/বিবিধ-২/২০০৮/১৯৭৬ ইএলইএফসিএস কর্তৃক পরিচালিত গভ. রেজি নং এস-১১৬৬০, চট্টগ্রাম বিভাগে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা, এইচআইভি, পরিবার পরিকল্পনা, টিকাদান কর্মসূচিসহ ফ্রি প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে শর্ত সাপেক্ষে বিভাগ পরিচালক পদে ৪, জেলা পরিচালক পদে ৪৮, পরিচালক (উপজেলা) ১২০, ইউনিয়ন অফিসার ৩০০ ও ওয়ার্ড স্বাস্থ্যকর্মী ৬০০ জন লোক নিয়োগ দেয়া হবে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় অফিস হিসেবে চান্দগাঁও খাজা রোডে হাজি আবু তাহের ভবনের ঠিকানা রয়েছে।
বিভাগীয় অফিসে দেখা দেখা মিলে কয়েকজন নারী-পুরুষের। তারা কার্যালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানান। তবে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করার আগে কী উদ্দেশ্যে আসা হয়েছে তা জানতে ব্যস্ত ছিলেন। চাকুরির উদ্দেশ্যে আসা হয়েছে উল্লেখ করা হলে তারা বলেন, আমাদের পরিচালক ও নির্বাহী পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
মুঠোফোনে পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন রানার সাথে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিষয়ে কথা হয়। তিনি নিজেকে পরিচালক ও ঢাকাস্থ প্রধান অফিসে থাকেন বলে জানান এবং সংবাদ মোহনা নামে একটি পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক বলেও দাবি করেন। পটিয়া উপজেলার এক আত্মীয়কে নিয়োগ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সমগ্র দেশে আমাদের নিয়োগ চলছে। চট্টগ্রাম বিভাগেও নিয়োগ দিচ্ছি। তবে চট্টগ্রাম বিভাগের এখনো বিভাগ ও জেলা পরিচালক নিয়োগ দিইনি। ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলছে। খাজা রোডে বিভাগীয় অফিস উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে রত্মা নামের একজন দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়োগপ্রার্থী এইচএসসি পাস বলা হলে রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ভালোই। খারাপ না। দিয়ে দেন। পটিয়া অফিস বা ইউনিয়ন অফিসে কাজ করতে পারবে। না হলে নগরের যেকোনো থানায় কাজ করবে। উপজেলা-থানা বা ইউনিয়ন পরিচালক হিসেবে কাজ করতে পারবে। বেতন ঠিক থাকবে তো – এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই’ ঠিক থাকবে। দিয়ে দেন কাজ করুক। আবেদনে আপনার রেফারেন্স দিয়েন, আমি দেখব। অফিস, প্রশিক্ষণ, সেবা প্রদানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বসে আলাপ আলোচনা করেই তা ঠিক করব। তবে অফিস নিজে করলেই ভালো। তাদের কার্যক্রম কী হবে – জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সদস্য সংগ্রহ, মাঠকর্মীদের প্রশিক্ষণ, প্রাথমিক ঔষধ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা দেয়া। পরিচালক দাবিদার রিয়াজ আরও বলেন, একশ টাকার বিনিময়ে আমাদের সদস্য হলে একজন এমবিবিএস ডাক্তার, একজন প্রশিক্ষিত পল্লী ডাক্তার, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাসহ জ্বর-প্রেসার চিকিৎসা সেবার সুযোগ-সুবিধা পাবেন। সব খরচ আমরা বহন করব। আমরা জেলা, উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে শাখা দিব। সেখানে গিয়ে আমাদের সদস্যরা সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। নিয়োগপ্রাপ্তিতে সদস্য সংগ্রহ করতে হবে – এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো সূর্যের হাসি, ব্র্যাক বা অন্য সংস্থার সদস্যদের চিকিৎসা দেব না। আমাদের সদস্যদের আমরা স্বাস্থ্য সেবা দেব।
নিয়োগকালীন জামানতের বিষয়ে রিয়াজ উদ্দিন বলেন, কোনো জামায়াত দিতে হবে না। তবে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা দিয়ে প্রেসার ও জ্বর মাপার যন্ত্র, এপ্রোন ও অন্যান্য সামগ্রী কিনে নিতে হবে। এগুলো তো ফ্রি দিলে কদর থাকবে না। যদি তা বিক্রি করে গার্মেন্ট বা অন্য কোথাও চাকরি নেয়, তাহলে আপনি তাদের খুঁজবেন কোথায়। কিনে না নিলে যতœ থাকবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঠকর্মীদের কাছ থেকে জামানতের নামে প্রতিজন থেকে নেয়া হচ্ছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এছাড়াও শাখা পরিচালকদের কাছ থেকেও ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। ব্যানার সাঁটিয়ে এবং পত্রিকায় চটকদার ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে নগর এবং জেলাজুড়ে এলএমএল পদ্ধতির প্রতারণার নতুন ফাঁদ আঁটা হয়। ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খুলে ওইসব শাখায় পরিচালক এবং স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের নামে তাদের কাছ থেকে জামানত হিসেবে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
স্বাস্থ্যকর্মীদের শেখানো হয় সাধারণ সদস্য সংগ্রহের পদ্ধতি আর হেলথ কার্ড বিক্রয়ের কলাকৌশল। ফ্রি চিকিৎসা সেবার কথা বলে একশ’ টাকায় হেলথ কার্ড বিক্রয় করা হয়। ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে এমএলএম পদ্ধতিতে প্রতারণার নতুন কৌশল বলে মন্তব্য করেছেন অভিজ্ঞ মহল।
এ বিষয়ে কথা হয় পেকুয়ার হেলাল উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, পত্রিকায় ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ পেয়েই মোবাইল ফোনে চাঁদের হাসি স্বাস্থ্য সেবার নির্বাহী পরিচালকের সাথে যোগাযোগ হয়। পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন রানার পরামর্শে নগরীর বহদ্দারহাট খাজা রোডে বিভাগীয় অফিসে আসি। তিনি পরিচয় করিয়ে দেন পরিচালক মো. পারভেজ শেখ (হৃদয়), ট্রেইনার রেবেকা সুলতানা (রেখা) এবং মহানগর সমন্বয়কারী মো. হাসানসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে। পরে আমাকে ঢাকার যাত্রাবাড়ির দয়াগঞ্জ মোড়ের পারগেন্ডারিয়ায় নেয়া হয়। সেখানে চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবার চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়ে কথা বলেন বাতেন নামের একজন। আমাকে চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবার পেকুয়া জেলা শাখার দায়িত্ব দেয়া হয়। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে ওই শাখায় বেশ কিছু স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। জামানতের সংগৃহীত টাকা চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষের একটি ব্যাংক একাউন্টে এবং নগদে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৬৫ হাজার টাকা জমা দেন। কিন্তু চিকিৎসা সরঞ্জাম কিংবা প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার মত প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসক সরবরাহ না করায় আমার সন্দেহ সৃষ্টি হয়।
হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ করে আমি এখন নিঃস্ব। পেকুয়ায় থাকতে পারছি না। নিয়োগ দেয়া স্বাস্থ্যকর্মীরা টাকা ফেরত চাচ্ছেন। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলাম প্রতারক চক্রের জালে আটকে গেছি।
আর দোকানে দোকানে মশার কয়েল বিক্রয়কর্মী মো. হাসান চাঁদের হাসি স্বাস্থ্য সেবার মহানগর সমন্বয়কারী। স্থানীয় দোকানদার আবুল বশর ১৫ হাজার টাকা জামানতের বিনিময়ে চাঁদের হাসি স্বাস্থ্যসেবা’র আরেফিন নগর শাখায় নিয়োগপত্র পেয়েছেন শাখা পরিচালক পদে। চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন ডা. এমরানুল হোছাইন। তাকে চট্টগ্রাম মহানগর জেলা মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার পরিচিতি কার্ডে লেখা আছে, হায়ার ডিপ্লোমা ইন প্যারামেডিক্স (ঢাকা), এইচপিটিপি (ঢাকা)। জেনারেল ফিজিশিয়ান, স্বাস্থ্য পরিচালক, চট্টগ্রাম মহানগর/ জেলা।
নিয়োগপত্রে উল্লিখিত এমরানুল হোছাইনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জামানতের টাকা-পয়সা নিয়ে আমাদের একটি করে ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা না থাকায় আমি পদত্যাগ করেছি। জামানতের ছয় হাজার টাকা এখনো ফেরত দিচ্ছে না। আমাদের এলাকা থেকে এভাবে লাখ দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, আরেফিন নগর শাখা অফিসের ভিতরে সাঁটানো পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ফটোকপি। সামনে ঝুলছে বিভিন্ন পদবিধারী ব্যক্তিবর্গের নামের সাথে পরিচালক মো. পারভেজ শেখের ছবি এবং ‘চাঁদের হাসিতে স্বাস্থ্য সেবা নিন, অপরকে সেবা নিতে উৎসাহিত করুন’ লেখা সম্বলিত ডিজিটাল রঙিন ব্যানার। স্বাস্থ্যকর্মীরা একশ’ টাকায় হেলথ কার্ড বিক্রয় করছেন বলে জানান কয়েকজন মাঠকর্মী।
জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুযায়ী শাখা পরিচালক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা মাঠ পর্যায়ে সদস্যদের নিকট কথিত হেলথ কার্ড বিক্রয় করবেন। মাসে একজন স্বাস্থ্যকর্মী কমপক্ষে একশ টাকা মূল্যের তিনশ’ হেলথ কার্ড বিক্রয় করলে ওই স্বাস্থ্যকর্মী বেতন পাবেন ছয় হাজার টাকা আর পরিচালক পাবেন ১০ হাজার টাকা। যেসব স্বাস্থ্যকর্মী তিনশ’ হেলথ কার্ড বিক্রয় করতে পারবেন না তাদের চাকরি স্থায়ী হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাঠকর্মী জানান, ‘ছয় হাজার টাকা জামানত দিয়ে মাসিক আট হাজার টাকা বেতনে স্বাস্থ্যকর্মী পদে নিয়োগ দেয়া হয়। একশ টাকা মূল্যের তিনশ হেলথ কার্ড বিক্রয় করা হলে বেতন-ভাতা পাওয়া যাবে এবং চাকরি স্থায়ী হবে। আমি যে একটি প্রতারক চক্রের ফাঁদে আটকা পড়েছি তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। অভিযোগ করে তিনি বলেন, নতুন আঙ্গিকে এমএলএম পদ্ধতির লোভনীয় ফাঁদে ফেলে জামানতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে।
সূত্র: দৈনিক পূর্বকোণ-২৭-০২-২০১৫ খ্রি:
আরো খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন-
এখানেও ক্লিক করুন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন